চলচ্চিত্রের ‘অগ্নিকন্যা’ মাহিয়া মাহি। একাধিক ব্যবসা সফল ছবির নায়িকা তিনি। রোমান্টিক, অ্যাকশন, কমেডি, গ্রামীণ, শহুরে যেখানে যেমন, মাহি সেখানে তেমন আকার ধারণ করতে পারেন। নিজের অভিনয় নৈপুণ্যে মাহি কয়েক বছরে নিজেকে নিয়ে গেছেন শীর্ষনায়িকাদের কাতারে। দেশ ছাড়িয়ে ওপার বাংলার অঙ্কুশ, সোহম ও ওমের সঙ্গেও কাজ করেছেন। সম্প্রতি চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি ঘোষণা দিয়েছে, ১২ এপ্রিল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশের সিনেমা হল বন্ধ করে দেয়া হবে। একজন শীর্ষস্থানীয় নায়িকার অবস্থান থেকে এ বিষয়ে মাহি কথা বলেছেন চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে..
অনির্দিষ্টকালের জন্য সিনেমা হল বন্ধের ঘোষণা এসেছে। আপনার মতামত জানতে চাই…
হায় হায়! আমি কী বলবো? (একটু থেমে…) আচ্ছা তাহলে আমার যেটা মনে হয় সেটাই বলি! এখনও যেসব হলে গেলে ছারপোকা মারতে হয়, সিট থেকে নারিকেলের ছোবড়া বেরিয়ে থাকে, সিট ভাঙা পাওয়া যায়, ঠিকমত ফ্যান চলে না, দর্শকদের ঘামে ভিজে সিনেমা দেখতে হয়; ওইসব হল থেকেও লাভ নেই। হয় হলের পরিবেশ ভালো হোক, নইলে এসব হল বন্ধ হয়ে যাক। হলের পরিবেশ যদি সুন্দর না হয় তাহলে দর্শক কখনই সিনেমা হলে যাবে না। ধীরে ধীরে মানুষ হলে যাওয়া বন্ধ করে দেবে। মানুষের হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন। সবাই ওয়েব সিরিজ দেখা শুরু করবে।
হলের পরিবেশ নিয়েতো অভিযোগ আছেই, কিন্তু ইদানিং নির্মিত বেশিরভাগ সিনেমা মানহীন। সিনেমা হলের পরিবেশ উন্নত করলে ওইসব ‘মানহীন’ সিনেমা দেখতে মানুষ হলে যাবে?
মানহীন ছবি নির্মাণ হচ্ছে এর অন্যতম কারণ উপযুক্ত বাজেট নেই বলে। যেখানে হেলিকপ্টার দেখানো উচিত, সেখানে দেখানো হচ্ছে ভ্যান গাড়ি। প্রযোজক হেলিকপ্টার দিলে যেটা খরচ হয়, ওই টাকা ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা পায়না। তাহলে সে কেন লোকসান করবে? প্রযোজকের টাকা উঠে আসবে যখন সিনেমা হিট হবে, দর্শক হলে যাবে। হলেই যদি মানুষ না যায় তাহলে প্রযোজকের হাতে টাকা ফিরবে না, হল মালিকও টাকা পাবেনা। সিনেমার মানও উন্নত হবেনা। একজন প্রযোজক বড় বাজেটের ছবি বানিয়ে চালাবে কোথায়? মাত্র কয়েকটা হলে চালালে তো টাকা উঠে আসবে না। সব সিনেমা হলে চলতে হবে। কিন্তু সব হলের যে অবস্থা, দর্শকের যাওয়ার পরিবেশ নেই। আলটিমেটলি সিনেমা হল সুন্দর হতে হবে।
আপনি বলতে চাইছেন সিনেমা হলের পরিবেশ উন্নত করলে সবঠিক হয়ে যাবে?
দেশের বাইরে গেলে কোনো কাজ না থাকলে সিনেমা হলে ঢুকে যাই। প্রায়ই কিন্তু কী ছবি চলছে সেটা খোঁজ নেই না। সিনেমা হলে ঢুকবো, খাবো দাবো সময় কাটবে। শুধু আমি না, অনেকেই এটা করেন! আমাদের দেশের সিনেপ্লেক্স, ব্লকবাস্টার আর ধানমন্ডিতে একটা নতুন হয়েছে (সীমান্ত সম্ভার) এই ছাড়া তো এমন উন্নত পরিবেশের সিনেমা হল নেই। এই কয়েকটা হল দিয়ে তো হবেনা। সব জায়গায় পরিবেশন সুন্দর হতে হবে। যেমন- রাজশাহী সদরে এখন কোনো সিনেমা হল নেই। সেখানকার মানুষ উন্নত পরিবেশে সিনেমা দেখার জন্য কি ঢাকা আসবে? এটা তো হয়না। তাই সিনেমা হলের পরিবেশ উন্নত হলে আলটিমেটলি প্রায় সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। মানুষ আবার সিনেমা হলে ফিরবে।
ধরুন সত্যি সত্যি দেশের সব সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেল, তাহলে কী হবে?
যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে মানুষ ফোনে পুরাতন সিনেমা দেখবে। সিনেমা বন্ধ হলে মানুষের এন্টারটেইনমেন্ট নেয়া থেকে তো আর দূরে থাকবে না। যেমন- আমি দুই বছর আগে শেষ হওয়া একটা সিরিয়াল প্রতিদিন ইউটিউব থেকে দেখি। কিংবা আমার সিনেমার গান দেখতে মন চাইলে ইউটিউব থেকে দেখি। সিনেমাগুলো নেটফিক্স, আইফিক্স থেকে দেখি। সত্যি যদি হল বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আইফ্লিক্স, নেটফিক্সসহ ওয়েব কন্টেন্ট নির্মাণ হবে। ওগুলো সিনেমার বাজেটেই হবে। মানুষ সেগুলো রিলাক্সে দেখবে।
সিনেমা হল বন্ধের বিষয়ে একজন চলচ্চিত্র শিল্পী হিসেবে আপনি শঙ্কিত?
শাবানা ম্যাডাম, আলমগীর স্যার, শাবনূর ম্যাডামের মতো শিল্পীদের ছবি যখন সিনেমা হলে চলতো তখন লাইন ধরে মানুষ হলে ভিড় করতো। হলের বাইরে ‘হাউজফুল’ লেখা থাকতো। এগুলো আমি পেলাম না। সবার কথা বলতে পারিনা নিজের উদাহরণ দিলাম। আমি মনে করি, আমার জন্য এটা দুর্ভাগ্য। সিনেমা হলের যে অবস্থা তাতে এসব আশা করাও ঠিক না। সিনেমা হল যদি বন্ধই হয়ে যায় তাহলে দর্শকদের ভিড়, হাউজফুল এগুলো থেকে বঞ্চিত হলাম না?
সিনেমা হলের মালিকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চান?
হ্যাঁ চাই। তাদের উচিত প্রত্যেকটা হল আগে সংস্কার করা। তারা ব্যবসা করবে কিন্তু হলের পরিবেশ ঠিক করতে ইনভেস্ট (বিনিয়োগ) করবে না? প্রথমে তারা হলের উপর ইনভেস্ট করুক। দেখুক না মানুষ হলে আসে কিনা! এই ভাঙাচোরা সিনেমা হলে আমি তো নিজেই যাবো না। আমি যেখানে যাবো না, সেখানে কেন আমার দর্শককে যেতে বলবো? আমি যাই সিনেপ্লেক্স, ব্লকবাস্টার, সনি, বলাকাতে। তাও আমি ভাঙাচোরা হলে গিয়ে ছবি দেখেছি। শুটিংয়ে বাইরে যে এলাকায় থাকি সেখানকার হলে আমার ছবি মুক্তি পেলে গিয়ে দেখেছি। এও দেখেছি, ঘামে শার্ট খুলে তাদের শরীর মুছতে আর ছবি দেখতে! এই অবস্থায় দেশের বেশিরভাগ সিনেমা হলে। আমার মনে হয়, মানুষ এখন দয়া করে সিনেমা দেখছে। কিন্তু এটা তো হওয়া উচিত না। মানুষ সিনেমা দেখে আনন্দ-বিনোদন পাওয়ার জন্য। একজন মানুষ রিলাক্স পরিবেশ না পেলে ওই ঘামে ভিজে, ছারপোকার কামড় খেয়ে আনন্দ বিনোদন পাবে না। তাইলে সিনেমা হল আগে ঠিক করতে হবে। বিকল্প রাস্তা দেখছি না।
সিনেমার খারাপ অবস্থা দূর করতে শিল্পীদের করণীয় কী?
প্রত্যেকেই যার যার নিজের জায়গা থেকে সঠিক কাজ করতে হবে। সিনেমা হলের মালিকদের তাদের হল সুন্দর করতে হবে। নির্মাতাদের উচিত, মনোযোগ দিয়ে খুব ভালো সিনেমা বানানো। এখনকার ট্রেন্ড ধরে সিনেমা বানাতে হবে। শিল্পীদের উচিত খুব বেশি পাঙচুয়াল হওয়া। সময়মতো শুটিংয়ে আসা। মানে কলটাইম ঠিক রাখা। যে ছবি ক্যারিয়ার চেঞ্জ করে দিতে পারে অথবা ক্লিক করবে প্রয়োজনে পারিশ্রমিক কমানো; ছবি মুক্তির আগে শিল্পীর প্রচারণায় যেতে হবে। আমাদের সবার উচিত সম্মিলিতভাবে কাজ করা। বসে থাকার সময় এখন না। হলের মালিক, শিল্পী, প্রযোজক, পরিচালক সবাইকে এক হয়ে কাজ করা উচিত।
আপনি আপনার ছবি মুক্তির আগে ঠিকভাবে প্রচারে অংশ নেন?
আমি আমার সব ছবির প্রচারে যাই না। এটা সত্য। কারণ আমি বুঝতে পারি কোন প্রচারণা কাজে দেবে আর কোনটা বিফলে যাবে। কাজে দেয়ার মতো প্রচারণা না হলে আর যেতে মনে চায় না। কিন্তু এটা করা আমার উচিত না। তাই আমি ঠিক করেছি, এখন থেকে আমার ছবিগুলোর প্রচারণায় ঠিকভাবে অংশ নেব।
শেষ প্রশ্ন। আপনার কি মনে হয় না, ছবি বাছাইয়ে আপনার আরও সচেতন হওয়া উচিত?
এজন্য কিন্তু আমি অনেকদিন ধরে কোনো সিনেমা সাইন করিনি। গতবছরের শেষদিক থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি খেয়াল করেছি, মাঝখানে কিছু ছবি করেছি সেগুলো দিয়ে দর্শক আমাকে গ্রহণ করেনি। এই বছরটা আমি খুব বুঝেশুনে পা বাড়াচ্ছি। সত্যি বলছি, দরকার হলে বসে থাকবো কিংবা বছরে একটা ছবি করবো। তাও মানহীন সিনেমা আর করবো না। অনেক অনেক কাজের অফার আসছে। পছন্দ হচ্ছে না, আমিও হাসিমুখে সালাম জানিয়ে না করে দিচ্ছি। যে ছবিটা ক্লিক করবে, আমাকে যদি নতুনভাবে কেউ উপস্থাপন করে বা আমাকে দর্শক পছন্দ করবে যে কাজ দিয়ে আমি তাই করবো।